বাঘ বৃত্তান্ত

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ নভেম্বর, ২০১১

অমাবস্যার সন্ধ্যা । খাটো, রোগা গাছগুলোর ঝাঁকড়া জঙ্গলে পথ করে নিতে রুক্ষ কাঁটাজমি ছেড়ে খোলা জিপ হঠাৎ নেমে পড়ল এক পাথুরে নালায় । বছরের এসময়টা জল থাকার কথা নয়, নেইও । কিন্তু পেল্লাই-সাইজের সব বোল্ডার আর এবড়ো-খেবড়ো চাট্টানের ‘রাস্তায়’ জিপসির পিছনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা হাতে নিজের ব্যালেন্সের আর মারুতির অ্যাক্সলের পরীক্ষা নিতে নিতে একবার মনে হল এর চেয়ে নেমে পড়লে হয়ত হেঁটে-বেয়ে এগুনো সহজ হত।

পাথর কেটে জলের যেমন খুশি বানানো এই পথ বেশ গভীর হলেও তেমন চওড়া নয় । ছাগলছানার মত এলোমেলো লাফাতে থাকা গাড়ি এগোচ্ছে দুপাশের দেওয়ালে ঠোকর খেতে খেতে । ইঞ্জিনের মরীয়া শব্দের কারনেই কিনা জানি না, জঙ্গলটা কেমন যেন অদ্ভুত নিঃসাড় । ততক্ষনে সূর্য ডুবেছে । নালার ভেতর থেকে দেখছি মাথার দুধারে গাছতলায়, বেড়িয়ে থাকা শেকড়ে জমছে অন্ধকার । অনেকটা ওপরে কালো ডালপালার ফাঁকে আকাশটা দ্রুত বদলাচ্ছে ঘন বেগুনী থেকে আরও ঘন বেগুনীতে ।

হঠাৎ কানের পাশে বাঁদিকের জঙ্গলটা খানখান হয়ে গেল একটা প্রায় অশরীরী চিল-চিৎকারে । ভালুকের ঘোঁত-ঘোঁত আগে অনেক শুনেছি, কিন্তু গলা ছেড়ে তার এমন আর্ত ডাক-এর অভিজ্ঞতা সেই প্রথম । কি কারনে ভালুকভায়া এত বিচলিত সেটা ঠাউরে ওঠার আগেই ওই তারস্বর চমকে দিল আরেকবার । আমাদের উপস্থিতি নিরাপদ কিনা ভাবছি, ডানদিকের জঙ্গল থেকে, যেন প্রত্যুত্তরেই, হেঁকে উঠলো এক গমগমে বাঘ । ক’মুহূর্তের নীরবতার পর আবার সেই স্নায়ু পঙ্গু করে দেওয়া হা-লু-ম, এবার আরও কাছে ।

বাঘ-ভালুকের এমন কানফাটানো যুগলবন্দিতে ফ্রন্ট-রো সিট পেয়ে যাবো কে জানত । দুই মেজাজি ওস্তাদের মাঝখানে এভাবে কতক্ষন কেটেছে খেয়াল নেই (পরে হিসেব করেছিলাম মাত্র মিনিট পনের) ।

একসময় সওয়াল-জবাবের একটু বিরতিতে খানিক সম্বিত ফিরতে দেখি গাড়ির হেডলাইটের চৌহদ্দির বাইরে সব মুছে দেওয়া ঘুরঘুট্টি রাত ।


অন্ধকারে শুখা নালার বোল্ডার ডিঙিয়ে জিপ্‌সি তখনও এগোবার ভণিতা করছিল। হঠাৎ পাথরে জবর ঠোক্কর খেয়ে ইঞ্জিনে একটা করুন গোঙানির শব্দ আর গাড়ি বেমক্কা পিছলে সামনের দুচাকা আকাশে । একহাতে আঁকড়ে ধরা খোলা জিপ্‌সির হুড-বাঁধার রড-এর জোড়-ঝালাই খুলে এল গোটা শরীরের ভারে ।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী-তে খাড়া হয়ে যাওয়া জিপ্‌সির হেডলাইটের আলো নালা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল মাথার ওপরের জঙ্গলে । চিত হয়ে পড়তে পড়তে আমার চোখ-ও স্বভাবত ছিল আকাশে । জানি না কোন কোরিওগ্রাফার-এর পক্ষে এতগুলি ভিন্ন মুহূর্তের এমন অলৌকিক সমন্বয় সম্ভব । অসহায় চিৎপটাং হতে হতে মাথার ওপরে দেখলাম লাফিয়ে নালা পার হয়ে যাচ্ছে বাঘ, গাড়ির আলো ঠিকরে পড়ছে তার দুধ-সাদা জোয়ান পেটে, গাঢ় অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে ঝলসে উঠছে সোনালি-কালো ডোরা-র ইঙ্গিত । ওই একটি-দুটি মুহূর্তই, কিন্তু স্মৃতিতে রয়ে গ্যাছে স্লো-মোশানে, যেন নালার এপার থেকে ওপারে হাওয়ায় ভেসে পার হচ্ছেন জঙ্গলের রাজা ।

এ গল্পের বাকিটা না-বলা থেকে যাওয়াই ভাল । ঘাড়ের ওপর বাঘ আর কাছেপিঠেই ভালুক নিয়েও আমরা ওই পাথরে লটকানো জিপ্‌সিটিকে শেষমেশ নালাছাড়া করতে পেরেছিলাম । বেঁচে যে ফিরেছিলাম সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে । কপালজোর বলে কথা! না হলে অমন বাঘদর্শন লেখা থাকে?

তা বলে ভাববেন না যেন নিয়মিত জঙ্গলে যাই বলে বাঘেরা পক্ষপাতদুষ্ট বা তাদের খুঁজে পাওয়ার কোনও মোক্ষম ফর্মুলা আয়ত্ত করেছি । অনেক ছোটবড়, দেশি-বিদেশি ওস্তাদ-কে জানি যারা বছরের বেশির ভাগটাই বনে-বাদারে কাটান । তাদের কাউকেই কখনও আজ-বাঘের-দেখা-পাবই এই গ্যারান্টি দিতে শুনিনি । আমার নিজের রেকর্ডও কিছু আহামরি নয়, পাঁচবার বাঘবনে গেলে হয়ত একবার দর্শন জোটে ।

অবশ্য বুঝি, বাঙালির এ ব্যাপারে একটু অভিমান স্বাভাবিক । যে বাঘকে তামাম দুনিয়া বাংলার নামে চেনে, তার ওপর বাঙালির এতটুকু অধিকার থাকতে নেই ? বাংলায় দু-দুটো টাইগার রিসার্ভ, তবু বাঙালিকে কিনা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখতে ভিন্‌রাজ্যে যেতে হয়?

বিশ্বায়নের যুগে ঘরের-বাঘ-ঘরেই-দেখব এই গোঁ ধরা যায় না। তবে ঘর ছেড়ে বেরোলেই যে দর্শন মিলবে, তারই বা গ্যারান্টি কি? নইলে সরিস্কা থেকে কাজিরাঙ্গা আর রাজাজি থেকে পেরিয়ার –- অবাধগতি বাঙ্গালী ভ্রমণার্থীর অযুত ক্যামেরায় ওই গাইড-প্রতিশ্রুত সোনালি-কালো ডোরা কি করে বছর-বছর অধরা থেকে যায়?

আবার এর উলটো দিকটাও ভেবে দেখুন । তেনার মর্জি হলে, আপনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তিনি হেঁটে যেতে পারেন একেবারে নাকের ডগায় । এমনকি টাইগার রিসার্ভের বাইরেও ।

এবছরই মে মাসের কথা । কলকাতার এক পুরনো বন্ধু সপরিবারে দঃক্ষিন ভারত ঘুরতে যাবার আগে বি আর হিলস আর বান্দিপুরে বাঘ দেখার অনেক সুলুকসন্ধান জেনে নিয়ে গেল । কিন্তু দু-দুটি নামজাদা টাইগার রিসার্ভে হপ্তাখানেক অনেক সাফারি হাঁকিয়েও যখন শিকে ছিঁড়ল না, দার্শনিক-গোছের মুখ নিয়ে বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে তারা গুটিগুটি রওনা হয়েছিল বান্দিপুর থেকে কুর্গের পথে। পথে নাগারহোলে ন্যাশনাল পার্কের কাবিনিতে খাওয়া । লেট লাঞ্চের পর একটু ঝিমুনি মত এসেছিল বোধহয় । তন্দ্রা ছুটে গেল ড্রাইভারের উত্তেজিত গলায় । চোখ খুলতেই গোধূলি আলোয় রাস্তা পার হয়ে অলস হেঁটে যাওয়া বাঘ ।

আমার বন্ধুজনের মধ্যে এমনও দেখেছি যারা কুড়ি-পঁচিশ বছর নিয়মিত জঙ্গল ঢুঁড়ে ফেলেও বাঘের ন্যাজটি অবধি স্পট করতে পারে নি। আবার এমনও ক্ষণজন্মাদের জানি যারা কপালে যেন বাঘ লিখিয়ে এসেছিল, না হলে জীবনের প্রথম সাফারি-তেই দশ মিনিটের মধ্যে বাঘের ক্লোজ-আপ ফটো ? তাও আবার করবেটের ঝোপঝাড়ে চোখ চলে না এমন জঙ্গলে?

এই অনিশ্চয়তাই আপনার বাঘের খোঁজের আসল রোমাঞ্চ । এ যে শুধু চোখের দেখায় সীমাবদ্ধ তা-ও নয় । রাজস্থানের রনথম্বর টাইগার রিসার্ভের শুখনো, খোলামেলা পর্ণমোচী বনে বাঘ দেখার সুযোগ অন্যান্য টাইগার রিসার্ভের চেয়ে অনেকটাই বেশি । কিন্তু এই আসাধারন জঙ্গল থেকে শুধু ট্যুরিসম জোনে সকাল-বিকেল সাফারি করে ফিরে এলে, বাঘের দেখা পান বা না পান, জঙ্গলের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ হবে না।

তার জন্য জিপ্‌সি ভাড়া করে একবেলা চলে যেতে হবে বানাস-এর কুলে । নদীতে বা পাড়-ঘেঁষে দেখতে পেয়ে যেতে পারেন চম্বলের বিখ্যাত মগর কুমীর । না পেলে, অপেক্ষায় বিকেল গড়াবে। বানাস-এর ওইপারে জঙ্গল-মোড়া আরাবল্লীর বুক থেকে খসে পড়বে অবসন্ন দিন, গহন সবুজ ধীরে নিভে যাবে এক স্বর্গচ্যুত, শিরশিরে সন্ধ্যায় । কান পাতুন, হয়ত দূর থেকে ভেসে আসবে ক্রমে আরও দূরে চলে যেতে থাকা কোন নিঃসঙ্গ বাঘিনির অধৈর্য ডাক । জঙ্গলে এমনটা হয়ে থাকে।

1 comment:

amitava sengupta said...

Darun laglo apnar "Bagh Britanto". Prasanggik bolei hoyto lov samlate parchhi na ,gata dosh bochhor Corbett,Pench,Manas,Shimlipal,Kajiranga,Suderban kore November 3 2013 Corbett r Bijarani r morning safari te tanr doshon millo,tiger grass r arale biraler moto squat kore nala theke jal kachchhe. vari sudar, vari natakeeyo chhilo drishyota.
Namaskar janben
amitava sengupta
Kolkata
maitreya54@gmail.com