কুঞ্জুম লা। ১৫০০০ ফুট ওপরে, অক্টোবরেই সুনসান। নভেম্বর
থেকে জুন এ পথ মাড়ায় না সেনাবাহিনীর জোঙ্গা-ও। সেই যমদুয়ার পার করেই জন্নত, শীতের
স্পিতি।
“কাম তো হোতে রহেগা,
ইন্দর সাব, পর আপকো ডর নাহি লাগতা?”
জিপ্সির টায়ারে মোটা চেইন
জড়ানো, দুধশাদা রোহতাং এর পথে এছাড়া কোন শব্দ নেই। তাই স্পষ্ট শোনা যায় ইন্দরের
নাতিদীর্ঘশ্বাস । কুসুমের থাক না থাক, তার তো মন আছে।
একটু আগেই, মানালিতে
জিপ্সির পেছনে ব্যাগ-বাক্স-ক্যামেরা ইত্যাদি রাখতে গিয়ে দেখি আদ্দেক জায়গা নিয়ে
কোদাল-বেলচা-দড়ি। প্রশ্ন করতে ড্রাইভার-জির সংক্ষিপ্ত “জরুরত হোগা” এবং ইন্দরের
একগাল অপ্রস্তুত হেসে “ভেরি থটফুল অব হিম”। তা হবে।
জবুথুবু শহর ছাড়ার কয়েক
মিনিট বাদে অস্বস্তিটা ফিরে এল। মাসখানেকও হয়নি এ পথে দেখেছি রোহতাংগামী
ট্র্যাফিকের রীতিমত জ্যাম। আমি, ইন্দর, আর দুই ক্যামেরা ও সাউনড অ্যাসিস্ট্যান্ট
মিলে এই রোহতাং লা উজিয়েই গিয়েছিলাম লাহুলের ইয়োচে গ্রামে। গ্রাম্ফু থেকে কেলং হয়ে
লেহ-এর পথে জিস্পা পেরিয়ে ডানহাতে ঘণ্টাখানেকের পিঠভাঙ্গা চরাই।
এযাত্রা পথচলতি দু-পাচটি
গাড়ি গুনতে গুনতে পিছনের সিট থেকে শুরুতে খেয়ালই করিনি রাস্তার যাছেতাই হাল ।
এলোমেলো ঝাঁকুনিতে টনক নড়তে গলা বাড়িয়ে দেখি রাস্তায়, দুধারে, মাঝেমধ্যে মাথার ওপর
ঝুলে থাকা গলা, পেঁজা আর জমা বরফের বহর । রোহতাং না পৌছতেই এই অবস্থা দেখে অনেকটা লালুবাবুর ঢংয়েই
আমার সওয়ালঃ “রোড আগে সেফ হ্যায় না, ড্রাইভার-জি?” কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে
ড্রাইভার-জির জবাবঃ “সেফ ভী বোল সকতে হ্যায়।”
সঙ্গেসঙ্গে ইন্দরের আবার
সহাস্য হস্তক্ষেপঃ “সেফটি তো ড্রাইভার কা উপর । রুপু সেড দিস ম্যান ইজ মানালি’স বেস্ট
ড্রাইভার...” রুপু, মানে রূপচাঁদ নেগি, ইন্দরের বাল্যবন্ধু, মানালির বিখ্যাত
মেফ্লাওয়ার হোটেল আর হিমালয়ান অ্যাডভেঞ্চার সংস্থার কর্তা । আমি আশ্বস্ত ঘাড় নেড়ে
ওঠার আগেই নির্বিকার মুখে ড্রাইভার-জির স্বগতক্তিঃ “রোড কা উপর ভী...”
কিছুক্ষন কারো মুখে কথা
নেই। তারপর, এক বরফিলা চরাই বাঁকে পিছলোতে থাকা গাড়ি সামলে স্টিয়ারিং-এর মালিক
ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করলেন। “আপকো মরনা হ্যায় তো মুঝে ভী ফাঁসা দিয়া মেরে বস নে।”
এরপর কোন কথা হয়? এখন আর ড্রাইভার বদলাবার সুযোগ আছে কিনা ভাবছি, প্রশ্ন এলঃ “কিউ যা রহে হ্যায় ইস টাইম?”
বোঝো, যেন কোন উপায় ছিল
না গিয়ে। আরেক প্রস্ত বিব্রত হেসে ইন্দর বোঝাতে থাকে। শীতের মাস ছয় সমস্ত ট্রান্সফরমার
বরফ চাপা পরায় লাহুল-স্পিতির অধিকাংশ গ্রামই ডুবে থাকে অন্ধকারে। সমুদ্রতল থেকে এত
ওপরে সূর্যের তেজ গনগনে হলেও আদ্দেক সময় দীর্ঘ তুষারঝড়ের রোদমোছানো আকাশের নিচে
কাজে আসে না সোলার প্লেট। কিন্ত হাড়জমানো ঝড়োবাতাস বনবনিয়ে ঘোরাতে পারে হাওয়াকল।
আমাদের ডকুমেন্টারি ফিল্ম
এই সোলার-উইন্ড যুগলবন্দীতে বিদ্যুৎ সমাধান নিয়ে। লাহুলের ইয়োচে-তে উইন্ডমিল খাড়া
করার পর্ব শ্যুট করে আমাদের গন্তব্য এবার স্পিতির লোসার গ্রাম, এই এক্সপেরিমেন্টের
আঁতুড়ঘর । শীতে না পৌঁছুলে
শীতের সমস্যা বুঝব কি করে? আর সিমলা থেকে কিন্নরের পথ অনেক নিরাপদ হলেও ওই রাস্তায়
স্পিতি যেতে-আসতে চারদিনের এক্সট্রা ভাড়া গুনতে হোত ক্যামেরাসমেত সবকিছুর।
“কাম তো নিকলনা হি হ্যায়,
ব্রাদার!” ইন্দর শেষ করতেই ড্রাইভার-জির সেই ব্রাদারলি প্রশ্নঃ “সাব, আপকো ডর নাহি
লাগতা?” খানিকটা ইন্দরের প্রতি মায়া আর অনেকটা আশঙ্কা-বিরক্তি নিয়ে ঠিক করলাম এবার
ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো। “আপ ডর রহে হো তো চলো ওয়াপস চলে!”
মুখ না ফেরালেও ইন্দরের
ব্রাদার যে নিঃশব্দে হাসছে বুঝলাম কাঁধের ওঠাপড়া দেখে। তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে,
“ঘাবড়াইয়ে মৎ!” এবার বেশ তেড়েমেরেই বললাম যে আমরা ঘাবড়াই না ঘাবড়াই, যে গাড়ি
চালাচ্ছে সে ঘাবড়ালেই মুশকিল। সুর নরম হলঃ “সরি! হর সাল সিজন কা দো-চার মাহিনা
স্পিতি রুট মে হি মেরা সাফারি চলতা হ্যায়। ইস টাইম কভি গয়া নাহি। পর পঁহুছা দেঙ্গে,
সাব।”
ততক্ষনে গাড়ি রোহতাং
পেরিয়ে গ্রাম্ফুর পথে। সিজনের ভিড় না থাকলেও গাড়ি যে একেবারে নেই তা নয়। সরকারি
ভাবে আরও হপ্তাখানেক হয়ত খোলা থাকবে রোহতাং লা। তাই বছরের শেষ রসদ পৌছচ্ছে কেলং
হয়ে লেহ-র রাস্তায়। গ্রাম্ফু থেকে ডাইনে স্পিতির দিকে বাঁক নিয়েই বুঝলাম বাকি পথটা
একলাই চলতে হবে।
কাগজেকলমে জানা ছিল
ব্যাপারটা গুরুতর। মাসখানেক হল কুঞ্জুম লা এ বছরের মত বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। সোজা
বাংলায়, আগামী জুন-জুলাইয়ে পাস খোলার আগে গ্রাম্ফু আর লোসারের মাঝখানে কোন
বিপত্তির দায় সরকার বা সেনাবাহিনীর নয়। আর কিছু না হোক, তুষারঝড়ে বা বরফধ্বসে ১৫০০০
ফুট ওপরে এই ৮০ কিলোমিটার দূরত্বের কোথাও আটকে পরলে, ছ-সাত মাসের আগে কেউ রাস্তা
খুলতে আসবে না। এসওএস পাঠাবার বালাই নেই কারন কুঞ্জুম লা মোবাইল নেটওয়ার্কের
বাইরে।
এসব ঝুঁকি নিয়েও স্থানীয়
মানুষ যে বিশেষ প্রয়োজনে ‘বন্ধ কুঞ্জুম’ পেরয় না এমনটা নয়। মাঝ-নভেম্বর পর্যন্ত
লোকাল জিপের যাতায়াত লেগেই থাকে। কিন্তু এই নভেম্বরের শেষে নেহাত দায় না পড়লে
তারাও এপথ মাড়ায় না। নিতান্ত যেতেই হলে, চার-পাচটা গাড়ি একসাথে চলে যাতে বিপাকে
পড়লে কোদাল-বেলচা চালাবার লোকের অভাব না হয়।
গ্রাম্ফু থেকে আমাদের
একাএকা গুটিগুটি চলে ছোটাধারা অবধি পৌছুতেই ঘণ্টা আড়াই। তারপর গাড়ি যত এগোয় পথ তত
পাথর থেকে আয়না। নিত্যনৈমিত্তিক ধ্বসের কারনে মানালি ছাড়ার কিছু পরেই পিচের রাস্তা
সীমানা শেষ। কাঁচা পাথুরে রাস্তার ঝাকুনিটা অভ্যেস হয়ে যাওয়ায় আর বরফচাপা পরার ভয়ে
পাহাড়ে আর আকাশে চোখ রেখে বুঝতেই পারিনি কখন গাড়ি নৌকোর মত টলমল হতে শুরু করেছে।
বাংলাতে snow-ও বরফ, ice-ও বরফ। কিন্ত
পেঁজা আর জমাট বরফে ফারাক অনেক। নরম বরফ তেমন গভীর হলে গাড়ির চাকা ফেঁসে যেতে
পারে। যেমন বালুতে বা কাদায়। জমাট বরফ আয়নার মত শক্ত ও মসৃণ। টায়ারে চেইন জড়িয়েও তার
ওপর গাড়ি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে রাখা অসম্বব। আর ১০-১২ ফুট চওড়া ওই টলমল পথের একপাশে
নিরন্তর অতলের ডাক শোনা গেলে, ওস্তাদ ড্রাইভারের পা-ও বারবার পৌঁছে যাবে ব্রেক-এ।
দাবালেই, স্কিড... চরকিবাজি... এবং চিত্তির! মানে, পপাত চ, মমার চ।
ততক্ষনে বরফের চাট্টান
হয়ে যাওয়া পথে এগুনোই মুশকিল। শ্যেনদৃষ্টি ড্রাইভার ব্যাপার গুরুচরন বুঝলেই গাড়ি
থামিয়ে নেমে পড়ছে কোদাল-বেলচা হাতে। বরফের চাদর ভেঙ্গে রাস্তা বানাবার প্রথম
চেষ্টায় ‘ব্যাপারটা কি’ দেখতে গাড়ি থেকে নেমেই বুঝলাম ভুল করেছি। দরজা খুলে
গদাইলস্করি চালে জমিতে পা রাখতেই, ধড়াস। কপালজোরে পাহাড়ের দিকে নেমেছিলাম, কাঁচের
মত বরফে হাত চারেক পিছলে পাথরের, থুড়ি বরফের, দেয়ালে সপাট ঠোকর। কোনমতে পাহাড়
ঘেঁষে উঠে দাঁড়িয়ে টাল সামলে বুঝলাম খাদের দিকের দরজা দিয়ে নামলে ওই পদস্খলন
অতলান্তগামী হত।
তারপর আরও অন্তত বার
পাঁচেক গাড়ি থামিয়ে বরফ ভেঙ্গে গ্রিপ ভিক্ষে করতে হয়েছিল কুঞ্জুমের পথে। কানফাটানো
হাওয়া, হাড়জমানো ঠাণ্ডা, গোমরা আকাশে লাগাতার ঝঞ্ঝাভাস আর যেকোন সময় গাড়ি যেকোন
দিকে চলে যেতে পারে জেনে একটা সময়ের পর কেমন একটা অকুতভয়, জীবনে-কি-আছে-ভাই ভাব
আসে মনে। চোখে পলক পরে না।
এখানে সেখানে পথের পাশে
ঘাড়ের ওপর ঝুলে থাকে তীক্ষ্ণ পেল্লাই আইসিকল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বরফে ডুবে থাকা বৌদ্ধ্ব
স্তূপ, ঝড়ো হাওয়ায় টিকে যাওয়া কয়েক সারি রঙচটা প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, আর কুঞ্জুমের প্রায়-ছোঁয়া-যায়
দুরত্বে অতিকায় বড়াশিগরি গ্লেসিয়র। ছবিতে অনেক দেখেছি এই ল্যান্ডস্কেপ, আগস্ট-সেপ্টেম্বরের
সবুজে আর নানা রঙে অলৌকিক। কিন্তু বিদ্যুত-মোবাইল-প্রাণ বিবর্জিত অমন কঠোর আদিমতা
এই একরঙা শীতে অন্যরকম সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর ।
No comments:
Post a Comment