|
সে ১৯৯২-এর কথা। কলকাতার এক রক্ষণশীল, সদ্য কো-এড কলেজে আমরা কয়েকজন এক আপাততরুণ অধ্যাপক-কে পটিয়ে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে বেড়ানোর প্ল্যান ফেঁদেছি। নানা কারনে শেষমেশ ট্যুরপার্টি কমতে কমতে দাঁড়াল মাত্র জনা পাঁচেকে, তার মধ্যে ছাত্রী একজনই এবং কলেজে জল্পনা অনেক।
যাওয়ার দিনকয়েক আগে, ওই আপাততরুণ অধ্যাপকের আরেক বিশেষ প্রিয় কিন্তু যেতে-চেয়েও-যেতে-না-পারা ছাত্রীর সঙ্গে দেখা ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে। রিডিং হল থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে অধ্যাপকের মুখোমুখি তার প্রথম প্রশ্ন নিরীহ সৌজন্যমুলকঃ “জঙ্গলে বেড়াতে যাছেন, স্যার?” অধ্যাপকের স্মিত হাসি মেলানোর আগেই, দ্রুত দ্বিতীয় প্রশ্নঃ “শিকার করতে?”
কতকটা তথৈবচ ‘স্যার’ জবাব খোঁজার আগেই মুচকি হেসে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে যেতে তার ফেলে যাওয়া গুনগুনানিঃ “শিকারি খুদ ইয়ানহা শিকার হো গয়া...”। বিশদে যাব না, সেই ছাত্রী এখন সমাজতত্বের অধ্যাপিকা। কিন্তু শিকার বলতে, জিম করবেটের বই–এর বাইরে, ওটাই বোধ হয় আমার প্রথম অভিজ্ঞতা ।
তা প্রায় চল্লিশ বছর হোল, এ দেশে শিকার মানে চোরাশিকার। যেখানেই জুড়ে দিন, ‘চোরা’ শব্দবন্ধটি কেমন যেন রোমাঞ্চক শোনায়। চোরা-চাউনি কি চোরাবালি-র মতই চোরাশিকারেও দেদার ঝুঁকি। সত্যি কথা বলতে ফাঁদ-পেতে-বাঘ-ধরা মাছ ধরার চেয়েও সহজ । আর হালুম-এর ধাক্কায় ভ্যাবাচ্যাকা বানরের মতো টপ করে খসে না পড়লে, মাচানে বসে বন্দুক দাগা অনেকটা ভিডিও গেমস-এ নিশানা সাধার মতোই। ক’জন শিকারি আর আলওয়ার মহারাজা জই সিং-এর মতো পায়ে হেঁটে বাঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়তে চায়।
তাই শিকারের আসল উত্তেজনা অনেকদিন হোল ওই ‘চোরা’ ব্যাপারটাতেই। এদেশে বেআইনি ঘোষিত হবার এক দশক আগেই শিকারের গৌরবে মরচে পড়তে শুরু করেছিল। মহারানি এলিজাবেথ (দ্বিতীয়) ১৯৬১ তে ডিউক অব এডিনবরা-র সাথে বাঘ মারতে পৌঁছন রাজস্থানের রনথম্ভরে। মহারাজা সয়াই মান সিং আর গায়ত্রি দেবীর আতিথ্যে তিন দিনের হুলুস্থুলু হাকা-হাতি-মাচান পর্বের শেষে দেশে-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে খবর যায় ডিউক আর মহারানির ট্রেজারর-এর হাতে শিকার হয়েছে দুটি প্রমান সাইজের বাঘ ।
ফতেহ সিং রাঠর, যার হাতে পরবরতিকালে রনথম্ভর আজকের চেহারা নেবে, তখন বন বিভাগের চাকরিতে নতুন। কয়েক বছর আগে এক সান্ধ্য আড্ডায় তিনি ফাঁস করেছিলেন যে ট্রেজারর নন, মহারানিই দ্বিতীয় বাঘটি শিকার করেছিলেন। মাচানে চড়ে তার হাতে .২৭৫ ম্যাগনাম রাইফেল পউছে দিয়েছিলেন ফতেহ নিজে। কিন্তু আন্তর্জাতিক শিকারবিরোধি গোষ্ঠীর সমালোচনা এড়াতে নাম নেওয়া হয় ট্রেজারর-এর ।
পঞ্চাশ বছর আগে ইংল্যান্ডের মহারানিকেই যদি গোপনে শিকার করতে হয়, আইনি নিশিদ্ধতার পর অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে গরিব চোরাশিকারি জেলখানার ভয়ে পাততাড়ি গোটাবে। কিন্তু শিকার যাদের একমাত্র ঐতিহ্য, তারা কি এত সহজে বাগ মানে? এ তো শুধু রোমাঞ্চ বা অভ্যাস নয়, অধিকাংশ শিকারি জনজাতিই অত্যন্ত গরিব। মাঝেমধ্যে তিতর-শুওর-হরিন না মারলে তাদের কপালে মাংস জোটা ভার।
কিন্তু এদেশে খুব কম জায়গাতেই লোকে বেড়ালের মাংস খায়। কিছু কিছু জনজাতির মধ্যে বনবেড়াল-এর নখ-দাঁত-গোনফ থেকে ওষুধ তৈরির প্রচলন থাকলেও চারদিকে লেপার্ড বা বাঘ শিকারের প্রকোপের পিছনে কারন মূলত বানিজ্যিক -- চিন-তিব্বত-মধ্য এবং দূর প্রাচ্যে চামড়া ও অন্যান্য দেহাংশের চড়া চাহিদা।
চোরাশিকার এর নানা তরিকা। সবচেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট ফাঁদ শিকার। ল্যান্ডমাইন পেতে গাড়ি ওড়ানোর মতই জঙ্গলে পুঁতে রাখা লোহার ফাঁদে থাবা কামড়ে বাঘ শিকারে বিশেষ বীরত্বের দরকার হয় না। কাঠিতে আঠা মাখিয়ে বা কাঠিজাল পেতে পাখি ধরা আর হরিনের চলার পথে লোহার তারের ফাঁস লাগিয়ে রেখে শিকার-ও ওই গোত্রেরই। হরিনের পিছনে শিকারি কুকুর লেলিয়ে দেওয়া বা বুনো শুওর-এর জন্য আটার গোলায় দেশি বোম লুকিয়ে রাখাও কুলীন শিকার-এর পর্যায়ে পড়ে না।
এই ঝুঁকিহীন এবং আপাত অনায়াস ফাঁদ শিকার-এর কারনেই দেশের অধিকাংশ জঙ্গলে আজ জানোয়ারের এমন আকাল। ক’বছর আগে ছত্তিসগড়ের বস্তারের জঙ্গলে কিছুদিন কাটিয়েছিলাম। কাগজে-কলমে টাইগার রিসার্ভ হলেও ইন্দ্রাবতিতে তখন প্রশাসনের প্রবেশ নিষেধ। বারবার বাহন এবং সারথি বদলে – এস ইউ ভি থেকে স্থানীয় জিপ, তারপর বাইক থেকে সাইকেল – সেঁধানো গিয়েছিল রেড জোন বা মুক্তাঞ্চলে।
এক গ্রামের দাওয়াতে বসে নানা কথার পর শিকারের প্রসঙ্গ উঠতেই সমবেত জোয়ান-বুড়ো সকলের মুখে স্বতস্ফুরত আক্ষেপ। বাংলা ভাবানুবাদে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ম্যাচ-রিপোর্টের ভাষায়, যেটা দাঁড়াবেঃ মৃগ নেই, মৃগয়া! ইডেনে কলিন কাউড্রের ১৯৬৪-র সেই ‘প্রেম নেই, ঘরসংসার’-মার্কা স্থবির ইনিংস দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু ইন্দ্রাবতির নিঃসাড়, স্থানু শাল-সেগুনের জঙ্গলে, অবিশ্বাস্য হলেও, জানোয়ার দর্শন দূরে থাক, সারাদিনে একটা পাখির ডাক-ও শুনিনি।
ফাঁদ শিকারের রমরমায় ভাববেন না যে বন্দুকধারী শিকারিরা অবসর নিয়েছেন। সরিস্কা বা পান্নায় বাঘ বিলুপ্তিতে ফাঁদ শিকার আর দেশি বন্দুক দুয়েরই নির্বিচার ব্যাবহার হয়েছিল। সাংবাদিকতা এবং এক সময় শিকার নিয়ে তথ্যচিত্র শ্যুট করার সুবাদে বেশ কিছু চোরাশিকারির সান্নিধ্য পেয়েছি। সান্নিধ্য শব্দটি ভেবেচিন্তেই লিখলাম, কারণ আইনের চোখে যত বড় অপরাধিই হোক, মোগিয়া, বাউরিয়া, চেঞ্চু বা লিসু শিকারির জঙ্গলজ্ঞান আর অরন্যকলা দুনিয়ার সেরা সংরক্ষনবিদ বা বনগবেষকদের লজ্জায় ফেলতে পারে।
দেবী সিং মোগিয়া-র সঙ্গে আলাপ ২০০৫-এ। আলাপ বলা ভুল হবে, কারণ প্রথম মুলাকাতটাকে ঠিক সামাজিক বলা চলে না। মধ্য প্রদেশের ছোট্ট গরিব গ্রাম ধামনী, দেবী সিং তার সরপঞ্চ। ধামনী থেকে উত্তরপশ্চিমে রনথম্ভর বা সয়াই মাধোপুর টাউন ট্রেনে-বাসে সাত-আট ঘণ্টার পথ । মাধোপুরের কাছেই রনথম্ভরের কিনারায় এক পাথুরে টিলার টঙে গুর্জরদের গ্রাম উলিয়ানা । বছর পনের আগে এক এসপি গুরুতর ঘায়েল হবার পর থেকে পুলিস বা সরকারি গাড়ি বিনা অনুমতিতে উলিয়ানায় সেঁধোয় না।
বছরে ছ’মাস দেবী সিং ধামনী ছেড়ে ঘর বাঁধত উলিয়ানায়। এ অঞ্চলে ক্ষেত পাহারার কাজে মোগিয়া আদিবাসি শিকারিদের বেশ চাহিদা। গ্রামের কিনারে ঝুপড়ি বেঁধে এরা দিনে নানা ফাইফরমাশ খাটে আর রাত্রে শিকার করে ক্ষেতে হানা দেওয়া শুয়োর কিম্বা চিতল। পরিস্থিতি অনুকুল বুঝলে বা খরিদ্দার পেলে অঞ্চলের মোগিয়া শিকারিরা গোপনে দল বাঁধে বড় শিকারের জন্য। উলিয়ানায় ডেরা বাঁধায় দেবী সিং-এর কোনও খবর পুলিশের কাছে ছিল না। তিন বছরে তার নেতৃত্বে বিভিন্ন মোগিয়া গ্যাং রনথম্ভরে শিকার করে ২২টি বাঘ।
স্থানীয় এনজিও টাইগারওয়চ-এর সহায়তায় দুই ছোট আর এক এক মেজো শিকারির সাথে পুলিশ হদিশ পেয়েছিল দেবী সিং-এর। মধ্য প্রদেশের সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সাদা পোশাকের রাজস্থান পুলিশ তাকে গভীর রাতে চালান করে কোটা জেলার এক থানা হাজতে। ‘বিশ্বস্ত সুত্রে’ খবর পেয়ে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম জয়পুর। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু লেখা যাবে না এই শর্তে রাজস্থান পুলিশের এক বড়কর্তার অনুমতিতে হদিশ মিলল কোটার গোপন লক-আপের।
থানায় আমাদের প্রথম কথোপকথন ছিল অসংলগ্ন । হঠাৎ গ্রেফতার হওয়ার ধাক্কা দেবী সিং তখনো সামলে উঠতে পারেনি। কিন্তু একটিও মিথ্যা না বলে সে নিজেই কবুল করেছিল অন্তত ২২ টি বাঘ মারার কথা। শনাক্তও করেছিল হাজতে মজুত বাকি চোরাশিকারিদের। সেদিনের পরে দেবী সিং-এর সাথে অনেকবার কথা হয়েছে। তার শিকারের গল্প সংক্ষেপে এইরকমঃ
মোগিয়া সমাজে সরপঞ্চ দেবী সিং-এর নামডাক বরাবরই। শ্বশুর রাজমল মোগিয়ার বাঘশিকারে ‘যশ’ থাকলেও, দিল্লীর এক চোরাকারবারির এজেন্ট উলিয়ানায় পৌঁছনর আগে এ ব্যাপারে বিশেষ ভাবেনি দেবী সিং। কিন্তু বাঘ পিছু ৫০ হাজারের অফার সে ফেরাতে পারেনি। নিজের বন্দুক থাকলেও তার প্রথম কাজ ছিল ছাল-ছাড়ানো আর হাড়গোড় বয়ে আনার জন্য পাঁচ-ছ’জনের দল গড়া। ভাই মুকেশ আর দুই শালা রুপ ও ভোলা কে নিয়ে শুরু। তারপর দেখতে দেখতে জুটে গিয়েছিল আরও জনা কুড়ি মোগিয়া যারা বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট দল বেঁধে ‘বড় শিকারে’ লেগে যায়।
গ্যাং তৈরি হওয়ার পরের কাজ টাইগার রিসারভের ভেতর জঙ্গলে পায়ে হেঁটে বাঘের থাবার ছাপ খোঁজা। নিয়মিত যাতায়াতের কোন সুঁড়িপথ শনাক্ত হলে কাছাকাছি সুবিধামতো বড়, পোক্ত গাছ বেছে নেওয়ার পালা । দিনের বেলা জঙ্গলে ফরেস্ট গার্ডের মুখোমুখি পড়লেও বিশেষ সমস্যা ছিল না। সঙ্গে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র না থাকায় কখনো সহজেই কাজে আসতো গোরু খোঁজা-জাতীয় অজুহাত, কখনো বা উলিয়ানা গাঁয়ের নাম। আর তেমন সেয়ানা গার্ডের সামনে পড়লে জ্বালানিকাঠ কাটার কথা বলে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া।
স্পট পছন্দ হলে শুরু হত পূর্ণিমার অপেক্ষা। লেট লাঞ্চের পর সন্ধ্যায় জঙ্গলে ঢুকে গাছের ডালে-আবডালে যে যার জায়গা নিয়ে নিত রাত সাতটা নাগাদ। বন্দুক থাকতো সচরাচর একটাই। তারপর জঙ্গল আলো ক’রে চাঁদ চড়তে থাকতো আকাশে। নিঃশব্দ, সজাগ শিকারির চোখ এড়াতো না বাতাসে কেঁপে ওঠা কোন ছায়াও। কখনো গুছিয়ে বসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেখা দিত বাঘ, আবার কোনদিন গোটা রাতই কেটে যেত অপেক্ষায়।
বন্দুক নিয়ে টাইগার রিসার্ভে ঢোকা এক জিনিস, লুকিয়ে-চুরিয়ে সুঁড়িপথে চলা হয়ত সম্ভবও বা। কিন্তু ফায়ারিং? আর গুলি লাগলে ওই বাঘের আহত গর্জন? অত শোরগোলে ফরেস্ট গার্ডের দল পৌঁছে গেলে? বেশ অবাক হয়েই দেবী সিং-এর পাল্টা অধৈর্য প্রশ্নঃ “ফরস্টওয়ালে রাত কো কাহান আতে হ্যায়?” খানিকটা অপ্রস্তুত আমি দ্রুত কথা ঘোরাই, বুঝতে কি করে গুলি নিশানায় লেগেছে? “ঘায়েল শের অ্যাঁউউ, অ্যাঁউউ করতা রেহতা থা যব তক জান না নিকল যায়ে।’’ খুব বেশি দশ-পনের মিনিট।
কিন্তু অন্ধকারে গাছ থেকে নেমে বাঘ ঘায়েল না মৃত যাচাই করার কোনও মানে হয় না। তাই ছাল ছাড়ানোর পর্ব শুরু হোত ভোরের আলো ফুটলে। তারপর মাংস আর চর্বি ছাড়িয়ে হাড় আলাদ করার কাজ। গ্রামে ফেরার পর ক্ষেতের মাটি খুঁড়ে নুন মিশিয়ে হাড়গোড় পুঁতে ফেলে গন্ধ কমার অপেক্ষা। স্যুটকেসবন্দি চামড়া অবশ্য পাচার হয়ে যেত দু-এক হফতাতেই।
ওই ২২ বাঘের মধ্যে দেবী সিং-এর হাতে শিকার হয়েছিল পাঁচটি । “পসলি মে, কান্ধা সে চার আঙ্গুলি পিছে, দিল পে মারনা পড়তা।’’ ফস্কে গেলে? একজন সর্দার শিকারির পক্ষে অস্বস্তিকরভাবে মৃদুভাষী দেবী সিং-এর মুখে সেই প্রথম দেখেছিলাম ধৈর্যের অভাবঃ “ব্যস, এক গোলি।’’ আমার মুখে তখনও অবিশ্বাশ দেখে সে বুঝিয়েছিল যে শিকার রেঞ্জের মধ্যে এলে মাজল-লোডেড বন্দুকে সুযোগ একটাই। লক্ষ্যভেদ না হলে কানফাটানো আওয়াজে সচকিত বাঘ ফের বারুদ ঠাসার সময় দ্যায় না ।
গতমাসে দেবী সিং-এর সময়কার আরেক দুঁদে চোরাশিকারি কেসরা মোগিয়া উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়া-র কাছে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেল। কেসরার খাতায় রনথম্ভরের বাঘের সংখ্যা ছিল চার। পুলিশ হেফাজতে দেবী সিং তাকে শনাক্ত করার আগে কোনোমতেই সে রাজি ছিল না অপরাধ স্বীকার করতে। কেসরা আমার শিকারের ডকুমেণ্টারিতে রনথম্ভর থেকে বাঘছাল সাপ্লাইয়ের রুট বাইক-বাস-ট্রেনে চেপে ঘুরে দেখিয়েছিল।
শ্যুটিং-এর ফাঁকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম কখনো নিরীহ জানোয়ার শিকার করতে খারাপ লাগতো কিনা। একটু অস্বস্তি নিয়ে কেসরা বুঝিয়েছিল যে একেকটা বাঘ শিকারে একেকজনের ভাগে পড়ত হাজার দশেক আর একটু ধৈর্য থাকলে মারা তেমন মুশকিলও ছিল না। তারপর, হয়ত আমাকে চুপ করে থাকতে দেখেই, চোখ নামিয়ে বলেছিলঃ “তিন বাচ্চা হ্যায়, পয়সা চাহিয়ে থা। আদমিসে গলতি হো যাতা হ্যায়।’’
আর দেবী সিং? কোটা লক-আপের প্রথম সাক্ষাতে একই প্রশ্ন শুনে তার বিভ্রান্ত চাউনি আজও মনে আছে। “পয়সা মিলতা হ্যায় তো আচ্ছা হি লাগতা হ্যায়, দুখ থোরি লাগতা হ্যায়? অব জো পকড়ে গ্যয়ে তো সমঝ আ রহা হ্যায় কি গলত কাম কিয়া।” দেবী সিং-এর ছোট দুই ছেলে এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। বড় দুজন বাপের সাথে ক্ষেতের কাজ দ্যাখে। আজ ধামনী চত্বরে কোন নতুন মোগিয়া শিকারি গ্যাং মাঠে নামলে দেবী সিং-এর ফোন পৌঁছে যায় রনথম্ভরে।
ফাঁদ পেতে বা গাছে বসে গুলি চালিয়ে শিকারে সাহসের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন দক্ষতার । বাঘের চলার পথ সঠিক চিনে নিয়ে জমিতে এমনভাবে ফাঁদ পোঁতা যে বাঘেও যেন টেরটি না পায় বা একটি মাত্র সুযোগে ঝোপেঝাড়ে হেঁটে যাওয়া বাঘের হৃৎপিণ্ড ছ্যাদা করে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু কপাল নিতান্ত খারাপ না হলে এমন শিকারে শিকারির বাঘের মুখে পড়ার বা ঘায়েল হবার সম্ভবনা সামান্যই। তাই আমায় জিগ্যেস করলে সেরা শিকারের শিরোপা কোন বাঘ শিকারির কপালে জুটবে না।
জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেন এমন সকলেই জানেন কোন সময় বাঘ সবচেয়ে বিপদজনক। শাবক-পরিবৃত সংসারী বাঘিনীকে ঘাটাতে নেই। আর কষ্টার্জিত শিকার সাঁটানোর সময় বাঘের চেয়ে দুরে থাকাই শ্রেয়। বুনো কুকুরের দলও সংখ্যায় অন্তত ডজনখানেক না হলে বাঘের ‘কিল’-এ নজর দেওয়ার সাহস করে না।
তাই প্রথমবার যখন শুনি কেউ বাঘের সদ্য শিকার করা হরিন থেকে কিলো পাঁচেক মাংস তুলে এনেছে, মনে আছে, প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে তাকে আত্মহত্যার অনেক সহজতর উপায় বাতলেছিলাম। অনেকটা মুজতবা আলির আব্দুর রহমানের মত ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে থেকে শেষমেশ যেন আমায় আশ্বস্ত করতেই সে দাবী করেছিল এ তার অনেকদিনের অভ্যাস।
প্রতি বছরই বাঘের শিকার চুরির লোভে দেশের নানা জঙ্গলে বেশ কিছু প্রাণ যায় – অধিকাংশের খবরও হয় না। কিন্তু তার (নাম নেওয়া ঠিক হবে না) যেন বাঘের সাথে জন্মের বখরা বন্দোবস্ত, তা প্রায় বছর দশেক হল মাসে অন্তত একবার সম্বরের রাঙ বাঁধা। ভেবেছিলাম এ এক আজব ব্যতিক্রম। ভুল ভাঙল ফতেহ সিং-এর সরিস্কায় প্রথম পোস্টিং-এর গল্পে।
ফরেস্ট গার্ড ভানওয়ার সিং-এর কাছে সরিস্কায় ফতেহ জঙ্গলের প্রথম পাঠ শেখেন। টাইগার ট্র্যাকিং-এ ভানওয়ার-এর জুড়ি ছিল না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ফতেহ আবিষ্কার করেন যে বাঘের চেয়ে বাঘের লুকিয়ে রাখা শিকার খুঁজতেই ভানওয়ার-এর উৎসাহ বেশি। শেষপর্যন্ত গার্ড সাহেব তার তরুন বসের কাছে স্বীকার করে যে বাঘের শিকার থেকে মাংসের ভাগ নিয়েই তার হেঁসেলের রমরমা ।
প্রমান দিতে পরদিনই ভানওয়ার ঢুড়ে ফেলে একটি সম্বর ‘কিল’। ঝোপের আড়ালে বসে ফতেহ-র জীবনে সেই প্রথম বাঘ দেখা। উত্তেজনা থিতোবার হবার আগেই ভানওয়ার এগিয়ে যায় লাঠি হাতে। আতঙ্কিত ফতেহকে বাকরুধ্ব রেখে সেই পেল্লায় বাঘ একপাশে আলতো সরে গিয়ে গার্ড সাহেবকে কেটে নিতে দেয় মাংসের এক বড়সড় চাঁই ।
না, ভানওয়ার-এর গল্পের পরে আমার মত বদলায়নি। শেষবার দেখাতেও তাকে (সত্যিই নাম নেওয়া ঠিক হবে না) বুঝিয়েছি যে বাঘের মুখের গ্রাস কাড়া অনুচিত, বেআইনি এবং একদিন না একদিন ওই ধাড়ি বেড়ালের ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়বেই । বরাবরের মত সে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে শুনেছে। সেই হাড়-জ্বালানো দৃষ্টির সামনে স্বীকার না করলেও মনে মনে মেনেছি, বাঘের শিকার শিকারের চেয়ে বড় শিকার আমার জানা নেই।
No comments:
Post a Comment